অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ এস আই মল্লিক
অধ্যাপক, শিশু ও কিশোর মনোরোগ বিদ্যা
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
অটিজ্ম সমপর্কিত ধারণা গ্রহণ ঃ
অটিজম একটি ব্যাপক বিকাশগত মানসিক রোগ। এতে বিশেষ করে সামাজিক বিকাশ ও ভাবের আদান প্রদান রুদ্ধ হয়ে পড়ে। শিশু সীমাবদ্ধ জীবনযাপন ও পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করে থাকে।
এই রোগের সাথে অতি চাঞ্চল্য, মানসিক প্রতিবন্ধিতা, জেদী ও আক্রমণাÍক আচরণ, অহেতুক ভীতি, খিঁচুনি ইত্যাদি থাকতে পারে।
এই রোগের সুনির্দিষ্ট একটি কারণ নেই। বংশগতির অস্বাভাবিকতা, শিশুর জন্ম পরবর্তী কোনো কারণ, ম¯িতস্কের স্বাভাবিক বিকাশ না হওয়া – জৈব রাসায়নিক অসাম্য ইত্যাদির কারণে ম¯িতস্কের ভারসাম্যহীনতার ফলে এই রোগের লক্ষণগুলি দেখা যায়। জন্মপরবর্তী কালের কোন কারণের জন্য এই রোগের সৃষ্টি হয় না। এরূপ কিছুর জন্য শিশুর এই রোগ হয়েছে বলে মনে করা এবং নিজেদের দোষী ভাবার কোন কারণ নেই।
অটিজম সারিয়ে তোলার কোন জাদুকরী চিকিৎসা নেই। এরূপ কোন পরামর্শে বিভ্রাšত হবেন না। তবে নিজেদেরকে অসহায়ও ভাববেন না। বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, আপনাদের শ্রম ও যতœ আর অটিজমের সাথে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও সাহায়ক দলের পরামর্শ আপনার শিশুর বিকাশে কাজে আসবে।
বাড়িতে করা সম্ভব এরূপ কর্মসূচীর বা¯তবায়ন ঃ
শিশুর বিকাশের লক্ষ্যে বাড়িতে নিুলিখিত ক্ষেত্রগুলিতে প্রদত্ত পরামর্শগুলি বা¯তবায়ন করুন। এজন্য নিজেরা সময় দিন, ধৈর্য্য ধরুন। দেখবেন ক্রমান্বয়ে শিশুর অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
ভাষা বিকাশের জন্য করণীয়
শিশুর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে বেশি বেশি করে কথা বলুন।
শিশুকে আপনার চোখের দিকে তাকাতে ও ঠোঁটের নাড়াচাড়া অনুসরণ করতে সাহায্য করুন।
শিশুকে ইশারা, ইংগিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে শেখান।
শিশু স্বাভাবিকভাবে কোন শব্দ উচচারণ করলে তাকে অর্থপূর্ণ শব্দে পরিণত করার চেষ্টা করুন।
প্রাথমিকভাবে দরকারী কিছু সহজ ও ছোট শব্দ শেখানোর জন্য নির্ধারণ করুন। সেগুলি ¯পষ্ট ও ধীরে ধীরে উচচারণ করবেন।
শেখানো কথাগুলি প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করুন ও তার সাথে নতুন শব্দ শেখানোর চেষ্টা করুন।
ছবির বই, জিনিষপত্র ও শরীরের অঙ্গপ্রত্য্রঙ্গ দেখিয়ে কথা শেখান। শিশুকে অক্ষর ও ছড়া গানের অডিও ক্যাসেট শোনাতে পারেন।
যেসব কথাগুলি শিশু বলতে পারবে সেগুলি যথাযোগ্য ব্যবহার করতে অভ্যেস করান।
সামাজিক বিকাশ
শিশুকে প্রয়োজনীয় সামাজিক আচরণগুলি শেখান। যেমনঃ- হাসির জবাবে হাসতে পারা, আদর করতে পারা, করমর্দন করা, সালাম করা, সম্ভাষন করা, বিদায়সূচক হাত নাড়া, আনন্দ প্রকাশ করতে পারা, শারীরিক ¯পর্শ দ্বারা বন্ধুত্ব করা ইত্যদি।
সমবয়েসী ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে ও ভাবের আদান প্রদান করতে শেখান।
শিশুকে সকল ধরনের সামাজিক পরিবেশে নিয়ে যান। যেমনঃ- আÍীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাসায়, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে, খেলার মাঠে, পার্কে, শপিং-এ ইত্যাদি। এরূপ পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে শিশুকে সাহায্য করুন।
শিশুর সাথে নিজেরা নিয়ম করে খেলবেন। প্রাথমিকভাবে সহজ কিন্তু আদানপ্রদান মূলক খেলা বাছাই করুন। যেমন – বল ছোঁড়া ও ধরা, লুকোচুরি খেলা ইত্যাদি। পারদর্শিতা ও শিশুর পছন্দ অনুযায়ী খেলনা এবং ক্রমান্বয়ে আরো গঠনমূলক খেলা দিন।
সমবয়েসী ছেলেমেয়েদের সাথে তত্ত্বাবধানের সাথে খেলতে দিন ও খেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে শিশুকে অনুপ্রাণিত করুন।
খেলার মাঠে, পার্কে নিয়ে যান ও সহজভাবে চলাফেরা করতে দিন।
স্বাবলম্বিতার বিকাশ
শিশুকে তার বয়েস ও বুদ্ধির মান অনুযায়ী ব্যক্তিগত দক্ষতাগুলি শেখান। যেমনঃ- যথাস্থানে প্রস্রাব-পায়খানা করা, নিজ হাতে খাওয়া, হাত-মুখ ধোয়া, দাঁত মাজা, গোসল করা, চুল আঁচড়ানো, জামা-জুতো পরা, পেনসিল-কলম দিয়ে আঁকি-বুকি করা সহ দরকারী জিনিসগুলো ব্যবহার করতে পারা।
এসকল কাজের মধ্যে সহজ ও প্রয়োজনীয় কয়েকটি বিষয় শেখানোর জন্য বাছাই করুন। প্রয়োজনে কাজটিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে এবং কীভাবে তা করতে হয় তা বারবার দেখানোর মাধ্যমে শেখান।
সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সহ হালকা ব্যায়াম করতে শেখান। পুষ্টিকর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার খেতে অভ্যাস করান।
বিশেষ দক্ষতার বিকাশ ও বিনোদনমূলক কাজের প্রশিক্ষণ
শিশুর বিশেষ কোন দক্ষতা থাকলে তাকে প্রশিক্ষণ ও সমর্থন দিয়ে বিকশিত করুন। যেমনঃ- খেলনা বা ইলেকট্রনিক্স জিনিস খুলে তা লাগাতে পারা, টিভির অনুষ্ঠানসূচি বলতে পারা, কোন কিছু চট করে মুখস্থ করার ক্ষমতা ইত্যাদি।
শিশুকে গান শোনান ও শেখান, টিভি দেখতে দিন, বেড়াতে নিয়ে যান, ছবি আঁকতে বা তার পছন্দের কোনো কাজ করতে উৎসাহ দিন।
জেদী আচরণ দূর করার উপায়
জেদী আচরণের পূর্বে এবং পরে কি হয়ে থাকে তা বিশ্লেষণ করুন। প্রয়োজনে এগুলি লিখে রাখুন ও আপনার চিকিৎসক/পরামর্শককে দেখিয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিন।
যৌক্তিক চাহিদা, হতাশা বা রাগের কারণে জেদী আচরণ করলে তা দূর করার চেষ্টা করুন। তবে অন্যায্য দাবী পূরণ করবেন না। মনে রাখবেন, এরূপ দাবী পূরণের মাধ্যমে জেদী আচরণ কমে না বরং ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
অসংগত জেদী আচরণ করলে শিশুর দিক থেকে মনোযোগ প্রত্যাহার করে নিন।
জেদী আচরণ বন্ধ করলে পুনরায় শিশুর দিকে মনোযোগ দিন।
উপরোক্ত বিষয়গুলি শেখানোর সাধারণ কিছু নিয়ম ঃ
শেখানোর জন্য্র এমন বিষয় বাছাই করবেন এবং এমনভাবে চেষ্টা করবেন যাতে শিশু সেটা করতে সক্ষম বা সফল হয়।
একই সাথে একাধিক বিষয় শেখাবেন না।
শেখানোর সময় তাকে মৌখিকভাবে এবং সমর্থনসূচক আচরণের মাধ্যমে উৎসাহ দিন।
শিশু কাজটি করতে বা শিখতে পারলে তাকে পুরস্কার দিন। এরকম পুরস্কার আদর কর, প্রশংসাসূচক কথা, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি থেকে চাহিদা মাফিক যে কোন জিনিস হতে পারে।
শিশুর ভুল কাজ, অযৌক্তিক আচরণকে আনুমোদন দেবেন না।
শেখানোর সময় শিশুর আগ্রহ, ইচ্ছা ও পছন্দকে গুরুত্ব দিন। ইতিবাচক মনোভাব দেখান। শিশুর ব্যর্থতার জন্য ধৈর্য্য হারাবেন না। মারধোর, বকাঝকা, ভয় দেখানো বা তুুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। শিশুর জন্য øেহ-মমতাময় ঘরের পরিবেশ গড়ে তুলুন। তাকে সকল ধরনের সমর্থন যোগান এবং অন্যের বিরূপ সমালোচনা ও আচরণ থেকে শিশুকে রক্ষা করুন।
সাধারণ ও বিশেষ শিক্ষা ঃ
শিশুর বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক থাকলে মৃদু ধরণের অটিস্টিক শিশু সাধারণ শিক্ষা লাভে সক্ষম। এরূপ পরামর্শ দেয়া হলে, তার সামর্থ্য অনুযায়ী একটি স্কুলে দিন ও ঘরের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখুন।
অটিস্টিক শিশুর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ একটি দলগত প্রক্রিয়া। প্রয়োজনে ও পরামর্শ দেয়া হলে এদরে জন্য নির্ধারিত বিশেষ স্কুলে দিন। এরূপ শিক্ষাকেন্দ্র শিশুকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে পারবে ও সেই সাথে আপনাদেরকেও নানা ভাবে সহায়তা করতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রোগের চিকিৎসা ঃ
অটিজমের সাথে অতিচাঞ্চল্য, জেদী ও আক্রমণাÍক আচরণ, নিজেকে আহত করা, অহেতুক ভয়, মৃগী রোগ ইত্যাদি থাকলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। দ্র্রুত চিকিৎসায় শিশুর অবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং তার বিকাশ ও প্রশিক্ষণের সহায়ক হবে।
অন্যান্য শিশুদের মত অটিস্টিক শিশুরও বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ হতে পারে। রোগের কতা তারা অন্যদের মত বলতে পারেনা। সেজন্য শিশুর স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখবেন। তেমন কোন অসুখের লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।
রেকর্ড সংরক্ষণ ঃ
শিশুর বিকাশ ও আচরণ এবং প্রশিক্ষণে বর্ণিত ক্ষেত্র্রগুলিতে শিশুর অগ্রগতি রেকর্ড একটি ডায়েরিতে সাপ্তাহিকভাবে লিখে রাখুন। নিজেরা এই রেকর্ড পড়ূন, বিশ্লেষণ করুন ও সেভাবে কর্মকৌশল নির্ধারণ করুন।
প্রতিবার সাক্ষাতের সময় এই রেকর্ডের ডায়েরি সঙ্গে আনুন যা চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট সকলেরই শিশুকে বুঝতে ও পরবর্তী পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে।